মহাভারতের যুদ্ধ কতদিন চলেছিল ও কয়টি “ব্যূহ” ব্যবহার করা হয়েছিল?

ব্যূহ কি?

ব্যূহ হল এক রণ নীতি। এক বিশেষ আকার ও বিশেষ কৌশলে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্য, রথী ও মহারথীদের প্রতিস্থাপন করে, নিয়মিত শত্রুপক্ষদের ওপর আক্রমণ ও সূত্র পক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করা হয়। সনাতন ধর্মের অগ্নি পূরণে প্রায় ১২৮ রকমের ব্যূহ কথা উল্লেখ করা রয়েছে।

ব্যূহ এমনই একটি রণনীতি যা সমর্থ যোদ্ধা ছাড়া ভেদ করা সহজ হত না। কয়েক হাজার কিলোমিটার জুড়ে কয়েক লক্ষ সৈনিক দ্বারা ব্যূহ রচনা হতো। আর ব্যূহ র আকৃতি অনুযায়ী বিশিষ্ট যোদ্ধারা তাদের যুদ্ধ কৌশলী দ্বারা শত্রুদের পরাস্ত করত। 

ঠিক তেমনি ভারতের বিখ্যাত মহাকাব্য মহাভারতে কুরুক্ষেত্রে যে মহা ধর্ম যুদ্ধ হয়েছিল, কৌরব ও পান্ডব দুই পক্ষই ব্যূহ র মতো গুরুত্বপূর্ণ রণনীতি ব্যবহার করেছিল। এবং মোট ১৮ দিনের যুদ্ধে বিভিন্ন প্রকারের ব্যূহ ব্যবহার করেছিল।

মহাভারতে বিভিন্ন ব্যূহ

মহাভারতের কৌরব ও পান্ডবদের মধ্যে ১৮  দিনের যে মহা ধর্মযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, তাতে যুদ্ধের প্রথম দিন থেকে আঠারো দিন পর্যন্ত দুই পক্ষেরই  সেনাপতি বিভিন্ন  ব্যূহ র নির্মাণ করেছিলেন সেগুলো হলো-

যুদ্ধের প্রথম দিন

মহাভারত মহাকাব্য অনুযায়ী, কুরুক্ষেত্রে যে ১৮ দিনের মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তাতে প্রথম দিন, কৌরব দের সেনাপতি “মহামহিম ভীষ্ম “সর্বতোভদ্র ব্যূহ” র (Flower Formation) নির্মাণ করেছিলেন। এবং তার প্রত্যুত্তরে পান্ডব সেনাপতি দৃষ্টদুন্য (দ্রপদীর ভ্রাতা) “বজ্র ব্যূহর” (Thunderbolt Formation) নির্মাণ করেন।

যুদ্ধের দ্বিতীয় দিন

কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনে কৌরব দের সেনাপতি “মহামহিম ভীষ্ম পদ্ম “পদ্মব্যূহ” (Lotus Formation) নির্মাণ করেছিলেন এবং প্রত্যুত্তরে পাণ্ডব সেনাপতি দৃষ্টদুন্য “ক্রঞ্চ ব্যূহ” র (Heron Formation) নির্মাণ করেছিলেন।

যুদ্ধের তৃতীয় দিন

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের তৃতীয় দিনে  কৌরবরা “গরুড় ব্যূহ” (Eagle Formation) নির্মাণ করেন ও তার প্রত্যুত্তরে পাণ্ডবরা “অর্ধ চন্দ্র ব্যূহ” (Half-Moon Formation) নির্মাণ করেছিলেন।

যুদ্ধের চতুর্থ দিন

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের চতুর্থ দিনে কৌরবরা “মন্ডল ব্যূহ” (Galaxy Formation) ও পান্ডবর “শ্রীঙ্গতক ব্যূহ” (Horn Formation) নির্মাণ করেছিলেন।

যুদ্ধের পঞ্চম দিন

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পঞ্চম দিনে কৌরবরা “মকর ব্যূহ” (Crocodile formation) ও পান্ডবরা “গরুড় ব্যূহ” (Eagle Formation) নির্মাণ করেছিলেন।

যুদ্ধের ষষ্ট দিন

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ষষ্ঠ দিনে কৌরব পক্ষ “ক্রঞ্চ ব্যূহ” (Heron Formation) ও পাণ্ডব পক্ষ “মকর ব্যূহ” (Crocodile Formation) নির্মাণ করেছিলেন।

যুদ্ধের সপ্তম দিন

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সপ্তম দিনে কৌরবরা “সর্বতো মুখ ব্যূহ” (Sphere with square Formation) এবং পান্ডাবেরা “সূচি ব্যূহ”(Needle Formation) নির্মাণ করেছিলেন।

যুদ্ধের অষ্টম দিন

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের অষ্টম দিনে কৌরব সেনাপতি “কুর্ম ব্যূহ” (Turtle formation) ও পান্ডব সেনাপতি “ত্রিশূল ব্যূহ” (Trident Formation) নির্মাণ করেছিলেন।

যুদ্ধের নবম দিন

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের নবম দিনে কৌরব পক্ষ “চন্দ্রকলা ব্যূহ” (Crescent Moon Formation) এবং পাণ্ডব পক্ষ “উর্মিব্যূহ”(Ocean formation) নির্মাণ করেছিলেন।

যুদ্ধের দশম দিন

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে দশমতম দিন পাণ্ডবরা কৌরব সেনাপতি “মহামহিম ভীষ্ম” কে পরাজিত করার জন্য “দেব ব্যূহ” (Conch Shell Formation) এর নির্মাণ করেন। এবং কৌরব সেনাপতি “মহামহিম ভীষ্ম” “অসুর ব্যূহ” (The Dome Formation) নির্মাণ করেন। কিন্তু যুদ্ধের দশম দিনে শিখণ্ডিনীর (দ্রৌপদীর ভগিনী) সহযোগিতায় পাণ্ডব ” ভীষ্ম ” কে পরাজিত করতে সমর্থ হয়।

যুদ্ধের একাদশ দিন

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের একাদশ তম দিনে কৌরব দের সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত হন ” গুরু দ্রোণ”।তিনি যুদ্ধে “সকটব্যূহ ” (Cart Formation) নির্মাণ করেন এবং প্রত্যুত্তরে পাণ্ডবরা “মণ্ডল ব্যূহ “(Galaxy Formation) নির্মাণ করেছিলেন।

যুদ্ধের দ্বাদশ  দিন

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের দ্বাদশ দিনে কৌরব সেনাপতি “গুরু দ্রোণ ” “দণ্ডব্যূহ” (Vertical Formation) ও পাণ্ডব সেনাপতি “দৃষ্টদুন্য” “সর্বাতমুখ ব্যূহ” (Sphere with Square Formation) নির্মাণ করেছিলেন। এবং যুদ্ধের দ্বাদশ দিনে দ্বিতীয় পাণ্ডব “ভীম” ১০০ জন কৌরব এর ২০ জন কৌরব কে পরাস্ত ও নিহত করে।

যুদ্ধের ত্রয়োদশ দিন

যুদ্ধের ত্রয়োদশ দিনে শুধুমাত্র কৌরব রা “চক্র ব্যূহ” (Wheel or Discus Formation) নির্মাণ করেছিলেন। আর পাণ্ডব দের সেনা কৌরবদের তুলনায় পরিমাণে অনেক কম থাকায় পাণ্ডবেরা কোন “ব্যূহ” নির্মাণ করেন নি। আর কৌরব দের এই “ব্যূহ” তে আটকা পড়ে “তৃতীয় পাণ্ডব” অর্জুন পুত্র অভিমন্যুর মৃত্যু হয়েছিল। রণ যত গুলো “ব্যূহ”র কথা উল্লেখ আছে সব থেকে ভয়ানক তম “ব্যূহ” হল “চক্র ব্যূহ”।

Mahabharat War Formation VYUHAS with Lord Krishna
Mahabharat War Formation “VYUHAS” with Lord Krishna

যুদ্ধের চতুর্দশ তম দিন

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে র ত্রয়োদশ তম দিনে, কৌরবরা তাদের জামাতা সিন্ধু রাজ জয়দ্রত কে পাণ্ডুপুত্র অর্জুনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে মোট ৩টি “ব্যূহ” নির্মাণ করেন। শাকাটাব্যূহ (Cart formation), পদ্মব্যূহ (Lotus Formation), সুচিব্যূহ (Needle Formation) । এই দিন পাণ্ডবরা কোন “ব্যূহ” নির্মাণ করেননি।

যুদ্ধের পঞ্চদশ তম দিন

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পঞ্চদশ তম দিনে কৌরবরা “ক্রঞ্চ ব্যূহ” নির্মাণ করেছিলেন এবং প্রত্যুত্তরে পাণ্ডবরা “সর্প ব্যূহ” নির্মাণ করেছিলেন। এই দিনে কৌরব সেনাপতি গুরু “দ্রোণাচার্যকে” পাণ্ডব সেনাপতি “দৃষ্টদুন্য” পরাজিত এবং নিহত করেন।

যুদ্ধের  ষোড়শ তম দিন

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ষোড়শ তম দিনে কৌরবদের সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত হন “অঙ্গ রাজ কর্ণ ” তিনি পাণ্ডব দের পরাজয়ের জন্য “মকরব্যূহ” নির্মাণ করেছিলেন এবং প্রত্যুত্তরে পাণ্ডব সেনাপতি “দৃষ্টদুন্য” ” চন্দ্রকলাব্যূহ” নির্মাণ করেছিলেন।

যুদ্ধের  সপ্তদশ তম দিন

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সপ্তদশ তম দিনে কৌরবরা “সূর্য ব্যূহ” ও পাণ্ডবরা “মহিষা ব্যূহ” নির্মাণ করেছিলেন। এবং এই দিনেই তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন কৌরব সেনাপতি “কর্ণ” কে যুদ্ধে পরাজিত করেন ও নিহত করেন।

যুদ্ধের  অষ্টদশ তম দিন

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের অষ্টদশ তম দিনে কৌরব দের সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত হন “মদ্র রাজ শল্য” তিনি পাণ্ডব দের প্রতিহত করার জন্য “শ্রীঙ্গতক ব্যূহ” নির্মাণ করেন এবং পাণ্ডবরা “পদ্ম ব্যূহ”র নির্মাণ করেন। কিন্তু যুদ্ধের অষ্টদশ তম দিনে প্রথম পাণ্ডব যুধিষ্ঠির মদ্র রাজ শল্য, পঞ্চম পাণ্ডব সহদেব গান্ধার রাজ শকুনী এবং দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীম জ্যেষ্ঠ কৌরব দূর্যোধন কে বধ করেন এবং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।

Leave a Comment