মনুষ্য জীবনে গুরুর প্রয়োজনীয়তা

‘ব্রাহ্ম সংহিতায়াম্’

               *ঈশ্বরঃ পরম কৃষ্ণঃ   সচ্চিদানন্দ বিগ্রহঃ।* 

               *অনাদিরাদি গোবিন্দমঃ সর্ব কারণ -কারণম্* 

অর্থাৎ  সচ্চিদানন্দ সরূপ শ্রীকৃষ্ণই, পরম ঈশ্বর। তিনি সকালে আদি এবং অনাদি, তার আদি আর কেউ নাই। তিনি গোবিন্দ সকল সৃষ্টির মূল ভীত। যে মহাবলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের *সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহার* কার্য সুসম্পন্ন হয়েছে বা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে তিনি এই বিশ্বের পরম ঈশ্বর বা গুরু।

গুরু মানে কি

যখন আমরা এই সংসারে আসি, তখন আমাদের *প্রথম গুরু* হলেন আমাদের *মা* । যিনি আমাদের এই সংসার সম্বন্ধে অবগত করান। এবং *দ্বিতীয় গুরু* হলেন আমাদের *বাবা।* তিনিও আমাদের এই সংসার সম্বন্ধে অনেক কিছু শেখান। এরপরে আমাদের জীবনের *তৃতীয় গুরু* হলেন আমাদের *শিক্ষক বা শিক্ষাগুরু* । যিনি আমাদের জীবনের বিভিন্ন রকম পরিস্থিতির সাথে লড়তে শেখান। এর পরে আসেন আমাদের *দীক্ষা গুরু*, তিনি আমাদের জীবনকে সর্বশ্রেষ্ঠ করে তোলেন। আমাদের জীবনকে লৌকিক থেকে অলৌকিক বানাতে সাহায্য করে।

গুরু শব্দের অর্থ

ভারতীয় শাস্ত্র অনুযায়ী *গুরু* কে জীবাত্মা ও পরমাত্মা মাঝখানে অবস্থিত সেতু বলা হয়ে থাকে। যদিও মানুষকে জন্ম তার মাতা-পিতা দিয়ে থাকেন। কিন্তু গুরু হলেন মানুষের প্রধান *পথপ্রদর্শক। গুরু আমাদের অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যেতে সাহায্য করেন ,গুরু *প্রদীপের* মতো যিনি  শিষ্যদের জীবন আলোকিত করে তোলেন। আমাদের মাতা পিতা যেমন, আমাদের দেহ কি সৃজন করে তোলে। তেমনি একটি সদ্ গুরু তার শিষ্যদের জীবন ও আত্মাকে সৃজন করেন। আমাদের সনাতন শাস্ত্র অনুযায়ী **গু* কথার অর্থ হলো অন্ধকার, এবং *রূ* কথার অর্থ হল নিবৃতি।অর্থাৎ যিনি আমাদের জীবনে অন্ধকারের নিবৃত্ত ঘটান তিনিই হলেন গুরু।

পরম পূজনীয় *গোস্বামী তুলসীদাস মহারাজ* তার বিখ্যাত সৃষ্টি রামচরিত মানসএ লিখেছেন:-

 “*গুরুবিন ভবানীধি তারেই না কোই ,* 

 **যো বিরঞ্চা শংকর সমহি “।* 

অর্থাৎ যে যতই *শিবসম* বলবান হোক না কেন, গুরু বিনা সে এই ভব সাগর পার করতে পারবে না। বেদ,পূরণ , উপনিসদ,রামায়ণ, মহাভারত,গীতা সমস্ত ধর্মগ্রন্থে সাধুসন্ত ও গুরুর অপার মহিমায় কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এমনকি ভগবান *রামচন্দ্র* (গুরু বিশ্বামিত্র) এবং ভগবান *শ্রীকৃষ্ণ* (সন্দিপনি ঋষি) ও গুরুর ছাত্র ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। অর্থাৎ ভগবান যখন মানুষের রূপে আসেন তখন তাকেও পথপ্রদর্শক হিসেবে গুরুর কৃপা লাভ করতে হয়।

 *গুরু ব্রহ্মা গুরু বিষ্ণু গুরুদেব মহেশ্বর* 

 *গুরুদেব পরমব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরুবে নমঃ* 

গুরু হলেন স্বয়ং *ত্রিদেব*, গুরু কে সাক্ষাৎ  *ব্রহ্ম* বলা হয়ে থাকে। গুরু আমাদের পরমার্থিক ভাব কে পরিপক্ক করে তোলে।, জীবনে যাপনের এক নতুন কলা শেখায়। ভগবান কে লাভ করার অধিকারী বানিয়ে দেয়। প্রত্যেক মানুষকে জীবনে গুরুর একান্ত প্রয়োজন। যদি কারো জীবনে গুরু না থেকে তাহলে বলা হয় সে এখনো জীবন শুরুই করেনি। যতক্ষন না গুরুর চরণ ধুলি তে নিজেদের আশ্রয় না খুঁজে পাই ,ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা ঈশ্বরিয় আভা মন্ডলের স্পর্শ ও করতে পারবো না। শাস্ত্র অনুযায়ী কোন ব্যক্তি যদি সৎকর্ম করে তার জীবনে যদি গুরু না থাকে,তবে ভগবানও তার সৎকর্ম স্বীকার করেন না। কারণ ব্যাংক তাকেই লোন দেয় যার গ্যারানটার মজবুত। গুরু হলেন আমাদের সেই গ্যারান্টার যিনি পরমাত্মা রুপি লোন আমাদের লাভ করতে সাহায্য করেন। যদি আমাদের এই ভব সাগর থেকে পার হয়ে পরম সচ্চিদানন্দকে লাভ করতে হয় তাহলে সৎ গুরুর আশ্রয় একান্ত প্রয়োজন।

সৎ গুরু চেনার উপায়

শিক্ষক সবাই হতে পরে।কিন্তু “গুরু” হওয়ার যোগ্যতা সবার থাকে না। বা যিনি বিদ্যা প্রদান করেন তিনিই গুরু নন।অনেক ব্যক্তি আছেন যিনি “গুরু” রূপে পরিচিত হন কিন্তু তাঁর শিষ্য গণ কে ভুল পথে পরিচালিত করেন। ভন্ডামি ও পাষন্ডের শিক্ষা প্রদান করেন।আমাদের সমাজে এমন  বহু ভণ্ড ব্যক্তি বর্তমান। যাঁরা গুরু রূপ ধারণ করে সাধারণ মনুষ্য দের ভুল শাস্ত্র ব্যাখ্যা করে পরমার্থের পথ থেকে বিচ্যুত করেন। এবং সমাজকে কলঙ্কিত করেন। তাই সনাতন শাস্ত্রে সৎ গুরু চেনার উপায় বর্ণনা করা আছে। তা নিম্নর রূপ

 “কিবা বিপ্র কিবা ন্যাসী শুদ্র কোন নয়

যেই কৃষ্ণ তও্ববেওা, সেই গুরু জয়।।”

বিপ্র, সন্ন্যাসী বা শুদ্র যাই হোক না কেন তিনি যদি কৃষ্ণ তত্ববেত্বা  হন তবে তিনি গুরু হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। অর্থাৎ “সৎ গুরুর” কোনো নির্দিষ্ট বংশে বা নির্দিষ্ট কুলে আবির্ভাব ঘটে না। বা রূপ, জাতী, কুল  দেখে “সৎ গুরু” চেনার উপায় নেই।

সুতরাং গুরু হওয়ার জন্য পাণ্ডিত্য নয়। “ভক্তি” এবং “জ্ঞান” থাকা আবশ্যক। গুরুদেবের প্রথম পরিচয় হলো তিনি একান্ত ভাবে পরমাত্মার ভক্তিতে সর্বদা লীন থাকেন। তিনি ভক্তির আশ্রয় ও ছাত্র ছায়াকে জীবনের একমাত্র অবলম্বন ভাবেন। তাঁর কৃপা আশ্রিত শিষ্যগণ  জন্ম – মৃত্যুর ভব  সংসার অতিক্রম করে ভগবানের পাদপদ্মে উপনীত হতে পারে। যিনি বাক্যের বেগ, মনের বেগ,ক্রোধের বেগ,জিহ্বার বেগ, উদরের বেগ,ও উপস্হের বেগ বিশেষ ভাবে সহ্য করতে সমর্থ শাস্ত্র মতে তিনিই “সৎ গুরু” হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। যার চিত্ত সর্বদা পরমার্থ ও সমাজ কল্যাণ রত থাকে সেই ব্যক্তিই আসল “সৎ গুরু”।” সৎ গুরুদেব” হলেন স্বয়ং “ঐশ্বরিক তত্ত্ব”।

গুরু সাক্ষাৎ পরমব্রহ্ম

 অর্থাৎ গুরুদেব ও ব্রহ্মতত্ত্বের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। চন্দ্র যেমন সুর্যের আলোয় আলোকিত,  নগুরুদেবও তেমনি ভগবানের দিব্য আলোয় আলোকিত। সাধরণ মনুষ্য সেই আলোকচ্ছটায় মনের অজ্ঞান রুপ অন্ধকারকে বিতাড়িত করে জ্ঞানের প্রকাশ ঘটায়। সুতরাং সেই জ্যোতিন্ময় ব্যাক্তিই হলেন সৎ গুরুদেব। “সৎ গুরুদেব” তাঁর সমগ্র জীবনের ভজন সাধন একত্রে অনায়াসে বিলিয়ে দেন তার শিষ্যের মুক্তির জন্য। আর সেই গুরুদেব শিষ্যকে  ভব সংসার থেকে পার করার জন্য কৃপা  করে সঠিক “জ্ঞান” প্রদান করেন । তাই পন্ডিত গনের মতে —  ঘোর দুরাচারী পাপী ব্যক্তিও যদি পাপ কার্য থেকে বিচ্যুত হয়ে “সৎ গুরুর ” কৃপা লাভ করতে সক্ষম হয়। তাহলে  সেই ব্যক্তিও তার কৃত সমস্ত পাপ থেকে  মুক্তি লাভ করে অনায়াসে ভব সাগর পর করে মোক্ষ লাভ করেন সক্ষম হয়। সুতরাং যিনি “সৎ গুরুর” চরণে আশ্রয় লাভ করেছেন তিনি অবশ্যই  এই সংসার রূপী ভব সাগর পার করে ফেলবেন। আর যে “সৎ গুরুর” আশ্রয় থেকেও পাপকর্মে লিপ্ত রয়েছে , থাকে কয়েক হাজার কল্প যাবৎ  “কালসুত্র নরকে”  ভয়ংকর শাস্তি ভোগ করে। 

Leave a Comment